সিপাহী বিদ্রোহ

পলাশী যুদ্ধের একশ বছর পর ভারতের উওর ও পূর্বাঞ্চলে প্রধানত সিপাহীদের নেতৃত্বে যে ব্যাপক সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তাকেই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে চরম শোষণ, সামাজিকভাবে হেয় করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, সর্বোপরি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ-এসবই মহাবিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি রচনা করেছে। নিম্নে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলো।

অর্থনৈতিক কারণ:

  • সম্পদ লুণ্ঠন:- ১৭৫৭ খ্রি. থেকে একশাে বছর ধরে ব্রিটিশ কর্তৃক বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিক দিক থেকে নিঃস্ব করে দেয় । পলাশির যুদ্ধের পর থেকে যে অর্থ নির্গমনের ক্ষীণধারা প্রবাহিত হতে শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীকালে স্রোতস্বিনীতে রূপান্তরিত হয় ।
  • কুটিরশিল্প ধ্বংস:- ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের স্বার্থে ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহের দেশে ও বিলাতি পণ্যের বাজারে পরিণত করা হয় । সুকৌশলে দেশীয় তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করা হয় । অষ্টাদশ শতক থেকে ভারতীয় বস্ত্রের রপ্তানি কমতে থাকে মূলত দুটি কারণে । প্রথমটি ছিল ইংল্যান্ডে ভারতীয় বস্ত্র রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা , দ্বিতীয়টি ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্যের বিনা শুল্কে ভারতে আমদানি , এর সামগ্রিক প্রভাবরূপে ভারতীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস হয় ।
  • কর্মহীনতা:- অগণিত তাঁতি ও কারিগর বৃত্তিচ্যুত হয়ে কর্মহীন শ্রমিকশ্রেণিতে রূপান্তরিত হয় । এ ছাড়াও দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে রাজপরিবারগুলির ওপর নির্ভরশীল অনুচর ও কর্মচারীরা কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে । কেবলমাত্র অযােধ্যাতেই অসংখ্য অসামরিক কর্মচারী ও প্রায় ২১ , ০০০ তালুকদারের আর্থিক সুযােগসুবিধা কেড়ে নেওয়া হয় । সেইসঙ্গে সেখানকার সেনাবাহিনীকেও ভেঙে দেওয়া হলে বহু সামরিক কর্মচারী ও অভিজাত পরিবারের জীবিকানির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায় । জন কে লিখেছেন — বহু সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা রাত্রে ভিক্ষা করতেন ।
  • চাকরি সংরক্ষণ:- সরকারি ভাষারূপে ইংরেজির প্রবর্তনের ফলে সংস্কৃত , আরবি , ফারসি প্রভৃতি দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষিত মানুষজন জীবিকা অর্জনের সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয় । সেইসঙ্গে কর্নওয়ালিশের সময় থেকে সরকারি উচ্চপদগুলি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় শিক্ষিত ভারতীয়রাও ছিল ক্ষুদ্ধ ।
  • চড়া রাজস্ব:- ব্রিটিশরা এদেশে নতুনভাবে যে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন করে তাতে বহু জমিদার বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব দিতে না পারায় জমিদারি হারান । এসব জমিদারিগুলি দখল করে ব্রিটিশ – অনুগত মহাজনশ্রেণি , যারা নিষ্ঠুরভাবে হতদরিদ্র চাষিদের কাছ থেকে চড়া হারে রাজস্ব আদায় করে কৃষককুলের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তােলে । রাজস্ব মেটাতে গিয়ে কৃষকরা বাধ্য হয় মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে , যা কোনােদিনই তারা শােধ করতে পারত না ।

রাজনৈতিক কারণ

  • স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়ােগ:- লর্ড ডালহৌসি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে স্বত্ববিলােপ নীতি ( দত্তকপুত্রের উত্তরাধিকারের দাবি অগ্রাহ্য ) প্রয়ােগ করে ঝাঁসি ( ১৮৫৩ খ্রি. ) , সাতারা ( ১৮৪৮ খ্রি. ) , নাগপুর , সম্বলপুর ( ১৮৫০ খ্রি. ) , উদয়পুর ( ১৮৫২ খ্রি. ) সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য গ্রাস করলে ওইসব রাজ্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চলে যায় । এই নীতির প্রয়ােগ ঘটিয়ে ব্রিটিশ পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও – এর দত্তকপুত্র নানাসাহেবকে তাঁর প্রাপ্য বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করে । ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও ও নাগপুরের রাজা ভোঁসলে অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁদের রাজ্য গ্রাস করা হয়েছিল ।
  • বিটিশের লণ্ঠন ও আগ্রাসী নীতি:- ব্রিটিশ নির্লজ্জভাবে কুশাসনের অজুহাত এনে অযােধ্যা ও নাগপুরের রাজপ্রাসাদ লুণ্ঠন করেছিল । ব্রিটিশ বাহিনী অযােধ্যায় নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ও তাঁর আত্মীয়দের রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং নাগপুরের ভোঁসলে রাজপরিবারের অবসান ঘটিয়ে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে । ব্রিটিশ চিফ কমিশনার কোভারলি জ্যাকসন নবাবের আমলাদের বিভিন্ন ভাতা বন্ধ করে দেন । নবাবের প্রশাসন ব্যবস্থা ও নবাবের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেওয়া হয় । বিহারের জগদীশপুর অঞ্চলের জমিদার কুঁয়র সিংহের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ রাজস্ব বিভাগ । এ ছাড়াও ব্রিটিশ মােগল বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে তাঁর পূর্বপুরুষদের আবাসস্থল লালকেল্লা থেকে সরিয়ে অন্যত্র বসবাসের ব্যবস্থা করে । শুধু তাই নয় , লর্ড ক্যানিং এক ঘােষণায় বলেন — দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-এর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরগণ আর বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করতে পারবেন না । ব্রিটিশের এই লুণ্ঠন ও আগ্রাসী নীতিতে ক্ষুদ্ধ হয় হিন্দু – মুসলমান উভয়শ্রেণির ভারতবাসী ।
  • উপজাতিগােষ্ঠীর ক্ষোভ:- ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পর কোল , ভিল , সাঁওতাল , মুন্ডা , মথুরার জাঠ , দিল্লির ফরাজি , ওড়িশার খন্দ , সিংভূমের কোলারি , মানভূমের ভূমজি এসব উপজাতিগােষ্ঠীর লােকদের ওপর ব্রিটিশের অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু হলে তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটে । এইসব সম্প্রদায় আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের মতাে করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ ঘােষণা করে ।
  • ব্রিটিশ-আশ্রিত রাজ্যগুলির বিদ্রোহ:- ব্রিটিশ-আশ্রিত রাজ্যগুলির মধ্যে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের সেনাদের ভাতা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে তারা ক্ষিপ্ত হয় ( ১৮০৪ খ্রি. ) । ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান ভেপু তাম্পি কালিকটের রাজাকে ব্রিটিশবিরােধী হয়ে উঠতে মদত দেন । আশ্রিত সামন্তশ্রেণিও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উগরে দেওয়ার সুযােগ খোঁজে ।
  • ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের অত্যাচার:- উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীরা সবক্ষেত্রেই ভারতীয়দের নীচু নজরে দেখত এবং সুযােগ পেলেই অত্যাচার করত । শেষ মােগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানাে হয় এবং সেনা অফিসার হাডসনের নির্দেশে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র ও পৌত্রদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । ব্রিটিশের এসব আচরণ ভারতবাসীর ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য বিনষ্ট করে । তাই স্কটিশ মিশনারি রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ বলেছেন — ইংরেজরাজের প্রতি ভারতীয়দের সামান্যতম আনুগত্য ছিল না ।

ধর্মীয় কারণ

  • রক্ষণশীলতায় আঘাত:- পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন , গঙ্গার জলে সেচের ব্যবস্থা , সতীদাহ ও সাগরে সন্তানবিসর্জন নিবারণ , বিধবা বিবাহ আইন পাস , রেলভ্রমণে জাতপাত প্রথার অবসান , টেলিগ্রাফ – টেলিফোনের প্রচলন প্রভৃতি প্রগতিশীল কার্যকলাপ রক্ষণশীল ভারতবাসী মেনে নেয়নি । ধর্মান্তরিত হিন্দুদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের মনে ধর্মনাশের আশঙ্কাকে ঘনীভূত করে তােলে । ভারতবাসী মনে করে ব্রিটিশ তাদের চিরাচরিত প্রথাগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করছে । শুধু তাই নয় সেনাবাহিনীতে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার , পাগড়ি পরা বা দাড়ি রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে উচ্চবর্ণজাত সিপাহিরা ক্ষিপ্ত হয় ।
  • এনফিল্ড রাইফেল:- সিপাহি বিদ্রোহে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিল এনফিল্ড রাইফেলে ব্যবহুত কার্তুজ । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় পুরাতন ‘ ব্রাউন বেস ‘ নামে গাদা বন্দুকের পরিবর্তে এখন থেকে সিপাহিদের এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার করতে হবে । এনফিল্ড রাইফেলের টোটার খােলসটি গােরু ও শুয়ােরের চর্বি দ্বারা তৈরি হত । রাইফেলের টোটার খােলসটি দাঁত দিয়ে ছিড়তে হত । এতে ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহিরাই ধর্মনাশের আশঙ্কায় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ।

সামরিক কারণ

  • ব্রিটিশ অফিসারদের অভদ্র আচরণ:- সেনাবাহিনীতে ইংরেজরাই সাধারণত অফিসার পদগুলিতে নিযুক্ত ছিল । তারা এতটাই দাম্ভিক ও উদ্ধত ছিল যে , ভারতীয় সিপাহিদের প্রতি কারণে – অকারণে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করত ।
  • বেতনের তারতম্য:- কোম্পানির ইংরেজ সেনা ও ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে বেতনের এক বিরাট ব্যবধান ছিল । একজন ভারতীয় পদাতিক সিপাহি বেতন পেতেন মাসে ৭ টাকা । এই সামান্য বেতনে পােশাক , খাওয়া ও ঘােড়া প্রতিপালনের পর হাতে থাকত সামান্য কিছু টাকা । অথচ ব্রিটিশ সেনারা বেতন পেত এর থেকে বহুগুণ বেশি ।
  • পদোন্নতির পথে বাধা:- সিপাহিদের পদোন্নতির সম্ভাবনাও ছিল খুব কম । কোনাে ভারতীয়ের পক্ষে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও সুবেদারের চেয়ে উঁচু কোনাে পদে পৌঁছােনা সম্ভব হত না । অথচ অনভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মচারী বা সেনাদের যথেচ্ছভাবে উচ্চপদে নিয়ােগ করা হত । ব্রিটিশ কর্মচারী কায়ে স্বীকার করেছিলেন , ভারতীয়দের পদোন্নতিজনিত ক্ষোভ যথেষ্ট তীব্র ছিল ।

সিপাহী বিদ্রোহের সূত্রপাত ও বিস্তার

  • ১৮৫৭ খ্রীঃ সিপাহী বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় প্রকৃতপক্ষে কলিকাতাব ১২ মাইল উত্তরে গঙ্গাতীরে বারাকপুরের সেনা ছাউনীতে। যুবক সৈনিক মঙ্গল পাণ্ডে চর্বি মেশান কর্তুজের জন্যে উত্তেজিত হয়ে উর্ধতন ইংরাজ অফিসারকে আক্রমণ করেন। ২৯শে মার্চ, ১৮৫৭ খ্রীঃ মঙ্গল পাণ্ডের সামরিক আদালতের বিচারে ফাসী হয়।
  • এরপর ২৩শে এপ্রিল মীরাটের সিপাহী ছাউনীতে চর্বি মেশানো কার্তুজ নিতে ৯০ জন সিপাহ অস্বীকার করায় তাদের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১০ই মে, ১৮৫৭ খ্রীঃ মীরাটের সিপাহী বিদ্রোহ ঘােষণা করে তাদের বন্দী সহকর্মীদের মুক্ত করে, ইংরাজ অফিসারদের হত্যা করে দিল্লী অভিমুখে রওনা হয়।
  • মীরাটের সিপাহীরা দিল্লীতে এলে, দিল্লীর সিপাহরা মেজর উইলােবিকে পরাস্ত করে দুর্গ ও অস্ত্রাগার দখল করে এবং দিল্লী নগরী দখল করে নেয়। দিল্লী ও মীরাটের সিপাহীরা বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাটরূপে ঘােষণা করে।

সিপাহী বিদ্রোহের বিভিন্ন কেন্দ্র:

দিল্লি

  • দিল্লিতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ও বখত খান। বখত খান ছিলেন বেরিলির একজন ব্রিটিশ সুবেদার।
  • দিল্লিতে বিদ্রোহ দমন করেন জেনারেল জন নিকলসন সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি যুদ্ধের সময় মর্টার ফেটে মারা যান।
  • লেফট্যান্যান্ট হডসন বাহাদুর শাহের পুত্র ও নাতিদের হত্যা করেন। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে হুমায়ুনের সমাধি থেকে ধরে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয় ও সেখানে মৃত্যু ১৮৬২।
  • ইংরাজ সেনা দিল্লি দখল করার পর বখত খান লক্ষ্ণৌ চলে আসেন। এই স্থানে ইংরাজের সঙ্গে যুদ্ধে ১৩ই মে, ১৮৫৯ খ্রীঃ তিনি প্রাণ দেন।

কানপুর

  • কানপুরে পেশবা দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের দত্তক পুত্র নানাসাহেব বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন।
  • তার প্রাপ্য ভাতা লর্ড ডালহৌসী স্বত্ববিলােপ আইন দ্বারা বাতিল করায় নানাসাহেব ইংরাজকে শিক্ষা দিতে মনস্থ করেন।
  • নানাসাহেব তার অনুচর তাতিয়া তােপী ও আজিমুল্লাহ খানের(নানার উপদেষ্টা) ওপর যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেন।
  • কানপুরে স্যার হাগ হুইলার নানা সাহেবের সেনাবাহিনীকে অবরােধ করেন এবং তিনি নানার কাছে বশ্যতাস্বীকার করেন। নানার সেনাবাহিনী সমস্ত ইংরেজদের হত্যা করেন।
  • মেজর জেনারেল হ্যাঙলক নানাকে পরাস্ত করেন ও জেনারেল নীল বহু ভারতীয় হত্যা করেন। কানপুর ছিল তাঁতিয়া টোপির নেতৃত্বে গােয়ালিয়রের অধীনে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্যার কলিন ক্যাম্পবেল কানপুর পুনরুদ্ধার করেন।
  • নানাসাহেব নেপালে পালিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান।
  • তাঁতিয়া টোপী সিন্ধিয়ার মান সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেন ব্রিটিশদের। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল তাঁর ফাঁসি হয়।

লক্ষ্ণৌ

  • লক্ষ্ণৌতে নেতৃত্ব দেন বেগম হজরত মহল ও আহমদুল্লা।
  • লক্ষ্ণৌতে স্যার হেনরি লরেন্স ব্রিটিশদের নেতৃত্ব দেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর হ্যাভলক আউট্রাম এবং নীল লরেন্সের সাথে যােগ দেন। নীল ও হ্যাভলকের মৃত্যু হয়।
  • তাঁতিয়া টোপি লক্ষ্ণৌ অধিকার করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ স্যার কলিন ক্যাম্পবেল লক্ষ্ণৌ পুনরুদ্ধার করেন।
  • বেগম হজরতমহল নেপালে পালান ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।

ঝাঁসি

  • ঝাঁসিতে নেতৃত্ব দেন রানি লক্ষ্মীবাঈ। লক্ষ্মীবাঈ ছিলেন ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-এর বিধবা রাণী।
  • সেনাপতি হিউরােজের আক্রমণে তিনি ঝাঁসি ত্যাগ করে সিন্ধিয়ার গােয়ালিয়র দুর্গ দখল করেন।
  • ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের কাছ থেকে ঝাঁসি পুনরুদ্ধার করেন।
  • ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন হিউরােজ গােয়ালিয়র পুনরুদ্ধার করেন।
  • ১৮৫৮ খ্রীঃ ১৭ই জুন যুদ্ধক্ষেত্রে তার মৃত্যু হয়।

বেরিলি

  • বেরিলিতে নেতৃত্ব দেন খান বাহাদুর খান।
  • ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে স্যার কলিন ক্যাম্পবেল বেরিলি পুনরুদ্ধার করেন।
  • খান বাহাদুর নেপালে পালান ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মারা যান।

বিহার

  • বিহারের আরাতে নেতৃত্ব দেন কুওর সিং ও অমর সিং।
  • কুনওয়ার সিং আরার যুদ্ধে ব্রিটিশকে পরাস্ত করেন।
  • উইলিয়াম টেলর ও ভিনসেন্ট আয়ার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সাময়িকভাবে কুঁওর সিংকে পরাস্ত করে আরা দখল করেন।
  • কুঁওর সিং ৯ মে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে মারা যান।

এলাহাবাদ ও বারানসী

  • এলাহাবাদ ও বারানসীতে নেতৃত্ব দেন লিয়াকত আলি।
  • ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে কর্ণেল নীল বারানসী ও এলাহাবাদ পুনরুদ্ধার করেন।

ফৈজাবাদ

  • ফৈজাবাদে নেতৃত্ব দেন মৌলবি আহমদুল্লা ও ফিরােজ শাহ।
  • মৌলবি আহমদুল্লা: পুয়াইনের রাজা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করেন।

ফারুকাবাদ

  • ফারুকাবাদে নেতৃত্ব দেন তুপজল হাসান খান।

বিজনৌর

  • বিজনৌর এ নেতৃত্ব দেন মহবৃত মহম্মদ খান।

মােরাবাদ

  • মােরাবাদ-এ নেতৃত্ব দেন আবদুল আলি খান।

সিপাহী বিদ্রোহে যাঁরা অংশগ্রহণ করেননি : সিন্ধিয়া এবং তার মন্ত্রী | দিনকর রাই, নিজাম ও তার মন্ত্রী সালার জং, হােলকার, কাশ্মীরের গুলাব সিং, ভােপালের বেগম, নেপালের প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুর, যােধপুরের রাজা, শিখরা। বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও রাজপুতানার শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এতে যােগ দেয় নি।

সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ

আত্মত্যাগ ও বীরত্বের নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও ১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় । সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার উল্লেখযােগ্য কারণগুলি হল —

নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব :

একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও জাতীয় পন্থা না থাকায় বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ চলতে থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ায় তা দমন করতে ব্রিটিশকে বিশেষ প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হয়নি ।

সর্বভারতীয় ঐক্য ও সংহতির অভাব

বিদ্রোহী সিপাহি ও নেতৃবর্গের মধ্যে সংহতি ও সর্বভারতীয় আদর্শের অভাব বিদ্রোহটিকে শেষপর্যন্ত সফল হতে দেয়নি । বৃহত্তর জাতীয় আদর্শের পরিবর্তে বিদ্রোহী নেতাদের অনেকেই সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট হয়ে পড়েন । যেমন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ চেয়েছিলেন মােগল শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটাতে , লক্ষ্মীবাই চেয়েছিলেন ঝাঁসি পুনরুদ্ধার করতে , আর নানাসাহেব মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পেশােয়া পদ ফিরে পেতে চেয়েছিলেন । এর পাশাপাশি বাংলার জমিদার ও বৃহৎ বণিকগােষ্ঠীর ব্রিটিশের প্রতি নীরব সমর্থন ছিল ।

যােগ্য নেতৃত্বের অভাব

বিদ্রোহীদের মধ্যে সুযােগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল । লক্ষ্মীবাঈ , কুঁয়র সিং , নানাসাহেব , তাঁতিয়া তােপী প্রমুখ নিজ নিজ এলাকায় দক্ষতার পরিচয় দিলেও সামগ্রিকভাবে বিদ্রোহ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন । লরেন্স , আউট্রাম , ক্যাম্পবেল , হ্যাভেলক , নিকলসন , নীল প্রমুখ ইংরেজ সেনাপতির সামরিক দক্ষতার তুলনায় ভারতীয়রা ছিল অনেক পিছিয়ে ।

আধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশলের অভাব

বিদ্রোহীদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল — অর্থ , রসদ , সমর উপকরণ ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যেকার বিশাল পার্থক্য । ব্রিটিশ পক্ষ যেখানে প্রচুর অর্থ এবং আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ও উন্নত রণকৌশলের অধিকারী ছিল , সিপাহিরা সেখানে ছিল সীমিত অর্থ , নিকৃষ্টমানের অস্ত্রশস্ত্র ও পুরাতন যুদ্ধপদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল ।

শৃঙ্খলার অভাব

শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে হলে যে শৃঙ্খলাবােধ , আনুগত্য ইত্যাদি গুণের একান্ত প্রয়ােজন , বিদ্রোহীদের মধ্যে তার যথেষ্ট অভাব ছিল । যার ফলে তারা বহু ক্ষেত্রেই জনসমর্থন হারায় ।

উন্নত যোগাযােগের অভাব

ডাক ও তার বিভাগের সাহায্যে ইংরেজরা বিদ্রোহের দ্রুত খবর পেয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জলপথ ও রেলপথে সেনা পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল । এইসব সুযােগ থেকে ভারতীয় সিপাহিরা বঞ্চিত হওয়ায় তারা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যর্থ হয়েছিল ।

সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের ফলাফল

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী । মহাবিদ্রোহের আদর্শ ও পরিকল্পনাগুলি পরবর্তীকালের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল । জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ গ্রন্থে লিখেছেন — এটি সমগ্র ভারতকে , বিশেষত ব্রিটিশ প্রশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ( ‘ It has shaken up the whole of India and particularly , the British administration ‘ ) ।

কোম্পানির শাসনের অবসানসিপাহি বিদ্রোহের পর ইংল্যান্ডের শাসক কর্তৃপক্ষ ভারতের মতাে একটি সুবিশাল দেশের শাসনভার আর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রাখতে ভরসা পেল না । তাই ২ আগস্ট ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ ভারত শাসন আইন ’ ( Government of India Act , 1858 ) পাস করে এবং ভারতের শাসনভার ইংল্যান্ডেশ্বরী মহারানি ভিক্টোরিয়ার হাতে অর্পণ করে । ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে যে আইন দ্বারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয় তার নাম ছিল ভারতে ‘ উন্নত ধরনের শাসন প্রবর্তনের আইন ’ ( Act for better Government in India ) । রানির প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর জেনারেল ‘ ভাইসরয় ’ উপাধি নিয়ে এই শাসন চালাবেন বলে স্থির হয় । ভাইসরয়ের অধীনে ৫ সদস্যবিশিষ্ট এক কাউন্সিল গঠিত হয় , যার সদস্যরা এক একটি দপ্তরের প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পান ।

মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘােষণা

উন্নততর ভারত শাসন আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিরূপে সর্বপ্রথম ভারতে ভাইসরয় হন লর্ড ক্যানিং । নবনিযুক্ত ভাইসরয় ক্যানিং এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত এক দরবারে , মহারানির হয়ে এক ঘােষণাপত্র পাঠ করেন ( ১৮৫৮ খ্রি . ১ নভেম্বর ) , যা মহারানির ঘােষণাপত্র নামে পরিচিত ।

দেশীয় রাজ‍্যনীতিতে পরিবর্তন

মহাবিদ্রোহের আগে পর্যন্ত দেশীয় রাজ্যগুলিকে রক্ষা করার ভুয়াে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়েছিল । এখন থেকে ব্রিটিশের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এদেরকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব রক্ষার কাজে লাগানাে হয় । লর্ড ক্যানিং তাই দেশীয় রাজাদের ‘ ঝড় – তুফানের বিরুদ্ধে পােতাশ্রয়ের সম্মুখস্থ বাঁধ ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন ।

সামরিক সংস্কার

সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ভারতের সেনাবাহিনীতে ইংরেজ ও ইউরােপীয় সেনার সংখ্যা বাড়ানাে হয় । মহাবিদ্রোহের সময় যেখানে ইউরােপীয় ও ভারতীয় সেনার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও ২ লক্ষ ৩৮ হাজার , মহাবিদ্রোহের পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৪ হাজার ও ১ লক্ষ ৪০ হাজার । গােলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়ােগ নিষিদ্ধ করা হয়। সীমান্তরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ইউরােপীয় সামরিক কর্মচারীদের উপর অর্পণ করা হয়।

মােগল সাম্রাজ্যের অবসান:

মহাবিদ্রোহের ফলে মােগল সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। শেষ মােগল সম্রাট বাহাদুর শাহ বন্দি অবস্থায় রেঙ্গুনে প্রেরিত হন এবং তার পুত্র ও পৌত্রগণকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে মােগল বংশের অবসান ঘটে।

বিদ্রোহ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকা :

বইলেখক
দ্য সিপাই মিউটিনি এ্যান্ড দ্য রিভােল্ট অফ ১৮৫৭/The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857রমেশচন্দ্র মজুমদার/R. C. Mazumdar
ইন্ডিয়ান ফাস্ট ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেস/History of the war of Independenceবীর সাভারকর
হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান মিউটিনি/History of the Indian Mutinyটি. আর হােমস/W. Malleson
এইটিন ফিফটি সেভেন/Eighteen Fifty Sevenসুরেন্দ্রনাথ সেন/S. Sen
অওধ ইন রিভােল্টরুদ্রাংশু মুখার্জি
এ হিস্ট্রি অফ দ্য সিপাই ইন ইন্ডিয়া/A History of the Sepoy war in Indiaজে ডব্লু. কি/J. Kaye
সিভিল ডিসটারবেনসেস্ ডিউরিং দ্য ব্রিটিশ রুল ইন ইণ্ডিয়াএস. বি. চৌধুরি
ভারতের মহাবিদ্রোহপ্রমােদ সেনগুপ্ত
ইন্ডিয়ান মিউটিনি অফ ১৮৫৭জে. বি. ম্যালেসন
দি সিপাই রিভােল্ট—ইটস কজেস এ্যান্ড কনসিকুয়েন্সএইচ. মিদ